ঢাকা , সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫ , ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​এক বাহনেই বরযাত্রী কিংবা শবযাত্রা!

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০৩-০৩-২০২৫ ০২:৩০:৩৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৩-০৩-২০২৫ ০২:৩০:৩৯ অপরাহ্ন
​এক বাহনেই বরযাত্রী কিংবা শবযাত্রা! ​ছবি: সংগৃহীত
বাস-লঞ্চ-ট্রেন কিংবা বিমান, গন্তব্যে যেতে একই পথে কতো বিপরীত পছন্দ আমাদের। আবার চিন্তা থাকে পরিবহনটা ভালো কি মন্দ? বিপজ্জনক নাকি নিরাপদ? যাত্রা আরামদায়ক হবে নাকি বিরক্তিকর? যাত্রাপথে এর চেয়ে আরও ভালো কী আছে? খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে নাকি আরও বাড়ানো যাবে? যাত্রাপথ নিয়ে এমন কতো কতো সমীকরণ। কিন্তু এমনো জনপদ আছে, যেখানে যেতে কোনো বিপরীত যানবাহনের চিন্তা করা কল্পনা। একটি বাহনেই যাতায়াত, যোগাযোগ বা পণ্য পরিবহণ সব কিছু। কোনো নবদম্পতির সুখের যাত্রার পাশাপাশি একই বাহনে পাড়ি জমায় কোনো রোগী-লাশ। যাতায়াতের এই পথ যেন এক জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি।

দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলাধীন ছোট্ট দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের কথা বলছি। চরফ্যাশনের ১৯ নং ঢালচর ইউনিয়নটি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত। মূল ভূখণ্ড (দক্ষিণ আইচা, কচ্ছপিয়া) থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এই দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, অপর তিন দিকে মেঘনা ও বুড়াগৌরাঙ্গ নদী। এই জনপদের সঙ্গে মূল উপজেলায় যাতায়াতের পথ একটিই-জলপথ। কিন্তু এই জলপথের জলযাত্রা আর জলযানটি একটু আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে। আজ সেই জলযানটির কথা হোক।

কচ্ছপিয়া থেকে ঢালচর যেতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। এই দূরত্বে একমাত্র বাহন-এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট একটি ছোট্ট লঞ্চ। একতলা ছোট লঞ্চটিতে বেশ গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে দ্বীপবাসীর যাতায়াত। ঢালচর থেকে প্রতিদিন সকাল ৮টায় কচ্ছপিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে লঞ্চটি। কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছায় দুপুর ১২টা নাগাদ। আবার কচ্ছপিয়া থেকে বিকাল ৩টায় ঐ লঞ্চটিই ছাড়ে ঢালচরের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা প্রায় ৭টা বাজে ঢালচরে পৌঁছাতে। এরপর রাতে লঞ্চটির বিশ্রাম। অর্থাৎ এই একটি লঞ্চই দিনে কেবল একবার ঢালচরবাসীকে নিয়ে যায় কচ্ছপিয়া, আবার দিনে একবারই ঢালচরে ফেরার সুযোগ থাকে।

ঢালচর থেকে কেউ চাইলেই যে কোনো সময় ভোলার মূল ভূখণ্ডে যেতে পারেন না। বলা চলে-তেমন সুযোগই নেই। আবার যারা বেলা ১২টায় কচ্ছপিয়া পৌঁছান, তারা কাজ সেরে ঐদিন দুপুর ৩টার মধ্যে ফিরতে পারেন না। ফলে ইচ্ছে না থাকলেও পরদিনের লঞ্চের অপেক্ষায় থাকতে হয়। এতে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন দ্বীপের রোগীরা।

এতো গেল কেবল সময়ের বাঁধাধরা সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গ। এরপর যাত্রাপথেও ভোগান্তি থাকে। ছোট্ট এ যানে বসার জায়গা পাওয়াও কঠিন। প্রচুর রোদের মুহূর্তে ক্লান্ত লঞ্চযাত্রী মাথা গুঁজতে অনেক যাত্রীর টার্গেট থাকে সুকানির (যিনি লঞ্চ চালান) ব্রিজে বসা। তবে সুকানির ব্রিজটি এতই ছোট যে, মাত্র দুজন ভাগ্যবান ব্যক্তি সুকানির দুইপাশে বসার সুযোগ পান। এছাড়া সুকানি ব্রিজের পেছনে আরও ৬জন যাত্রী বসার সুযোগ থাকে। যদিও সেখানে পর্দানশিন নারীদেরই সম্মানার্থে বসতে সুযোগ দেওয়া হয়।

ছোট লঞ্চটিতে যাত্রীর পাশাপাশি নানা মালামাল চোখে পড়বে। কচ্ছপিয়া থেকে ঢালচরে যাওয়ার সময় কোনো দোকানির চাল, ডাল, মুদি মাল, গ্রাসের সিলিন্ডার, ঔষধ থেকে শুরু করে দ্বীপবাসীর প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য পরিবহণ করে। আর দ্বীপ থেকে কচ্ছপিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে বহন করে মাছের বড় বড় ঢোপ (মাছের বোঝা)। বরফের চাদরে মুড়ে যেসব মাছ ঢাকায় চালান হয়, তা কচ্ছপিয়ার আড়তদার পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এই লঞ্চটি। এতকিছুর পরেও এই ছোট্ট লঞ্চটিকে চরবাসী বেশ ভালোবাসেন। চরবাসীর দৃষ্টিতে-এই লঞ্চ তাদের জীবনযাত্রার অংশ। শেষ অবধি এই ছোট্ট লঞ্চটিই তাদের সম্বল। এই লঞ্চটিই তাদের অ্যাম্বুলেন্স, এই লঞ্চই তাদের সেতু, এই লঞ্চই লাশবাহী গাড়ি।

ট্রলারের মতো ছোট্ট এই লঞ্চটির আশায় প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকেন কোনো কোনো মা। সন্তান ফিরবে বলে বিকালেই ঘাটে এসে বসেন কোনো বাবা। দ্বীপের বাইরে যে মেয়ের বিয়ে হয়, সে এই লঞ্চেই যাত্রা করের শ্বশুরবাড়ি। আবার কোনো মেয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এলে এই ঘাট-লঞ্চই ব্যবহার হয়। অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসার জন্য শহরে নিয়ে যেতে হয় এই লঞ্চেই। শহরে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিটির লাশ দ্বীপে পৌঁছায় এই লঞ্চটাতে। এককথায় সুখ আর কান্নারা একসঙ্গে পাড়ি জমায় এই জলযানে।

ছোট্ট লঞ্চটি এই পথে কবে এভাবে সার্ভিস দেওয়া শুরু করে? জানতে চাইলে লঞ্চটির চুকানি জানালেন, সে প্রায় ১০ বছর হলো লঞ্চটি যোগ হয়েছে। এর আগে এখানে ট্রলার চলত। এখন আরও একটু বড় লঞ্চ দরকার। কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে উঠছে না। বর্ষা মৌসুমে দুশ্চিন্তা নিয়েই এই লঞ্চ পাড়ি জমায়। আবহাওয়া পরিস্থিতি খারাপ হলেও এই লঞ্চ চালাতে হয়। কারণ একটাই পথ, একটাই বাহন। যত খারাপ পরিস্থিতিই হোক, ঘরে যেতেই হয় ঢালচরের বাসিন্দাদের। এই লঞ্চ ছাড়া ঘরে ফেরার উপায় নেই।

লঞ্চটির প্রতি দ্বীপের বাসিন্দাদের আবেগ অপরিমেয়। অনেক দিনের বন্ধুত্ব। প্রয়োজনের সাথি। দ্বীপের প্রবীণ বাসিন্দা সুলতান মিয়ার কাছে এই লঞ্চ যেন পরিবারের সদস্যদের মতোই। জানালেন-কতো শতবার যে এই লঞ্চে চড়ে যাতায়াত করতে হয়েছে, তা ঠিক আন্দাজ করাও দুরূহ। তবে তার মনে পড়ে, তিনি ছোটবেলায় এক পথটুকু ৫০ পয়সার বিনিময়ে (নৌকায়) পাড়ি দিতেন। জোয়ার ভাটার গণের ওপর তখনকার যাতায়াত অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল। এরপর যুবক বয়সে দেখেছেন মেশিন লাগানো খোলা ট্রলার, দুই টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকার পরে ২০ টাকা ভাড়ায় চলাচল করেছেন। এখন ভাড়া গুনতে হয় ৭০টাকা করে।
 
ঢালচরের বাসিন্দাদের কাছে এমন যাতায়াত যেন খুবই স্বাভাবিক এখন। ঠিক রুটিন করে খাওয়ার মতোই রুটিন করে যাতায়াত। তবে স্বাভাবিক সময়েও চরবাসী যে কতটা অস্বাভাবিক দিন কাটায় তারই একটি প্রমাণ এই জলযাত্রা। তবুও তারা এই যাত্রাকে ভালোবেসেই দিন কাটায় ঢালচরের জনপদ।


 
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ